শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৯

মহাযাত্রা ১ - যুক্তরাষ্ট্রের সাত অঙ্গরাজ্য ভ্রমণ

সেমিস্টার শেষ হতে না হতেই মাথায় ঘুরতে লাগলো- একটু আশেপাশে ঘুরে আসা দরকার। এই ঘুরে বেড়ানোর চিন্তাটা এমন যে একবার মাথায় ঢুকলে আর বের হতে চায় না। শেষমেষ অবস্থা এমন দাঁড়ালো, পরীক্ষা’র পড়ালেখা বাদ দিয়ে আমি পরীক্ষা-পরবর্তী ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলাম অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে। নিজেকে প্রবোধ দিলাম এই বলে যে পি এইচ ডি’র ছাত্রদের জন্য রেজাল্ট কোনো বিষয় না, কোনোমতে ন্যূনতম গ্রেড পেয়ে কোর্সগুলা পাশ করলেই চলবে (এ কথা সত্য কী না জানি না, কোনোদিন পি এইচ ডি শেষ করে চাকরির বাজারে গেলে হয়তো বুঝতে পারবো/ হাড়ে হাড়ে টের পাবো)।

ভ্রমণের পরিকল্পনা করাটা বেশ মজার একটা বিষয়। এটা আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে করে যেতে পারি। পরিকল্পনা’র মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে গুগল ম্যাপে বিভিন্ন জায়গা খুঁজে খুঁজে এমন একটা পথ বের করা যেটা অনেকগুলা আকর্ষণীয় স্থান ছুঁয়ে যাবে আর এই পথে’র স্থানে স্থানে রাত্রিযাপনের জন্য স্বস্তায় হোটেল বা এয়ার-বি-এন-বি পাওয়া যাবে।

ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করার ঘন্টাখানেক পরই খেয়াল করলাম, আমার ভ্রমণের পরিধি “আশেপাশে” থেকে ক্রমশ “দূরদূরান্তে” হারিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম এরিজোনা’র সাথে কর্ণসম্পর্কে  আবদ্ধ অঙ্গরাজ্য কলোরাডো-তে গিয়ে ঘুরে ফিরে আসবো। পরে দেখলাম সেই পরিকল্পনা উত্তরোত্তর আরও উত্তরে ডালপালা মেলছে। শীঘ্রই লক্ষ্য করলাম উত্তরের অঙ্গরাজ্য ওয়াইয়োমিং ছাড়িয়ে উত্তরতর অঙ্গরাজ্য ‘মন্টানা’য় যাওয়ার জন্য আমার মনটা না কেমন যেন করছে। মন থেকে ’মন্টানা’  অনেক কষ্টে ঝেড়ে ফেলে আমেরিকা’র বিখ্যাত জাতীয় উদ্যান “ইয়েলোস্টোন” পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ করলাম, যেটা ওয়াইয়োমিং আর মন্টানা’র সীমান্তে অবস্থিত। ভ্রমণের উদ্দেশ্যও ঠিক করলাম - কোথাও গিয়ে বেশি সময় অবস্থান করবো না, ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে শুধু আমেরিকা’র দু-চারটা অঙ্গরাজ্যের প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র একটু চোখ বুলিয়ে দেখবো। অবশ্য “আশপাশ” এর “দূরদূরান্ত” হয়ে যাওয়ার মতোই “দু-চারটা” পরবর্তিতে “দুইটা” এবং “চারটা” মিলে “ছয়টা” হয়ে গিয়েছিল।

প্রাথমিক দুশ্চিন্তা ছিল এতো দূরের রাস্তা একা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া। ক্যালিফোর্নিয়া ট্যুরের শেষে নিদ্রাজনিত কারণে ঘটে যাওয়া এক বড়সড়(ক) দুর্ঘটনা’র রেশ এখনও যায় নাই আমাদের মন থেকে। তাই মূল সতর্কতা’র বিষয় ছিল আমি যেন গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে না পড়ি।
আরেক দুশ্চিন্তা আমার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মরিয়ম। তার এই অবস্থায় প্রথমে আমি একা ঘুরতে চলে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনাটাই আমার কান্ডজ্ঞানহীনতার প্রমাণ দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল, কিন্তু আমার বেআক্কেল মন সেই প্রমাণে কোনো খুঁত রাখতে চাইলো না; আমার স্ত্রীকে, আমাদের সাড়ে পাঁচ বছরের ছেলে মুস’আবকে আর ‘নেগেটিভ’ তিন মাস বয়সী অনাগত সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই বের হয়ে পড়লাম পৌনে তিন হাজার মাইলের লং-ড্রাইভ এ। ৭ দিনের ট্যুর এ ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাতিত এরিজোনা’র বাকি প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য - নিউ মেক্সিকো, কলোরাডো, ইউটাহ এবং নেভাডা চষে ফেললাম, সেই সাথে সরাসরি প্রতিবেশী না এমন আরও দুইটা অঙ্গরাজ্য - ওয়াইয়োমিং আর আইডাহো।



আমাদের প্রথমদিনের সফর এরিজোনার টেম্পি শহর থেকে নিউ মেক্সিকো হয়ে কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের কলোরাডো স্প্রিংস নামক শহরে যাওয়া। যাত্রা শুরু করে মূলতঃ পূর্ব দিকে প্রায় দশ ঘণ্টা ড্রাইভ করে পৌনে পাঁচশ মাইল পাড়ি দিয়ে চলে গেলাম নিউ মেক্সিকো’র রাজধানী শহর ‘সান্তা-ফে’-তে। এটা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরাতন রাজধানী-শহর। শহরের স্থাপনাগুলোর নকশায় এখনও এই পুরাতন-পুরাতন ভাবটা ধরে রাখা হয়েছে - ইচ্ছে করেই।
এই ভ্রমণে সান্তা ফে তে আমাদের রাত্রিযাপনের ইচ্ছা ছিল না, তাই ঘন্টাখানেক সেখানে অবস্থান করে সন্ধ্যা’র আগে  রওয়ানা দিলাম উত্তর দিকে কলোরাডো স্প্রিংস এর উদ্দেশ্যে। এরিজোনা আর নিউ মেক্সিকো’র আবহাওয়া এবং ভূমি’র চেহারা মোটামুটি কাছাকাছি, দুইটাই মরুভূমি। আশেপাশে বড়সড় গাছপালার দেখা পাওয়া শুরু করলাম সান্তা ফে থেকে উত্তর দিকে কলোরাডো’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার ঘন্টাদুয়েক পর। ততোক্ষণে অবশ্য আঁধার নেমে এসেছে। কলোরাডো স্প্রিংস-এ ইউ এস এয়ারফোর্স একাডেমির কাছে আমাদের হোটেলে পৌঁছাতে বেজে গেল রাত প্রায় এগারটা।
কলোরাডো স্প্রিংস এ ইকোনোলজ এ আমাদের দুই রাত থাকার কথা। হোটেলে পৌঁছেই মরিয়ম রাইস কুকারে নুডলস আর খিচুড়ি রান্না করে ফেললো অল্প সময়ের মধ্যেই। এইসব লং ট্যুরে সাথে একটা রাইস কুকার এবং চাল-ডাল-তেল সহ আনুষঙ্গিক মশলাপাতি নিয়ে আসলে বাইরে খাওয়ার ঝামেলা এড়ানো যায়। হোটেলের বদ্ধ রুমের ভিতর রান্না করলে দেশি মসলা সমৃদ্ধ রান্না’র কিছুটা গন্ধ রুমে থেকে যায়। সেটা রান্নার সময় হোটেলের এক পাশের জানালা খুলে রেখে আমরা কিছুটা কমিয়ে রাখতে পেরেছি।

দ্বিতীয়দিন সকাল সকাল উঠে হোটেল থেকে বের হয়েই কলোরাডো স্প্রিংস এর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। গত রাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় অন্ধকারে কিছু দেখতে পাইনি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ফিট উচ্চতার এই শহরের পূর্ব দিকে তাকালে দেখা যায় রকি মাউন্টেইনের পূর্ব পার্শ্বের বেশ কিছু পর্বতশৃঙ্গ। গ্রীষ্মের আগমণের প্রাক্বালে পর্বতগুলার বরফ সবে গলতে শুরু করেছে। চূড়াগুলো পুরোপুরি সাদা হলেও একটু নিচের দিকে সাদাকালো ডোরাকাটা নকশা করা পর্বতশৃঙ্গ-গুলা দেখলে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। আমরা পাইক্‌স পীক দেখার জন্য রওয়ানা দিলাম। পাইক্‌স পীক কলোরাডো’র সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। অবশ্য এর প্রবেশদ্বারে টোল আদায়ের অফিসে গিয়ে শুনলাম চূড়ায় ওঠার পথ আপাতত বন্ধ, বৈরি আবহাওয়ার কারণে। তবে যতদূর যাওয়া গেল তাতেই আমরা খুশি। গাড়ি চালিয়ে খুব দ্রুত অনেকটা উচ্চতায় উঠে যাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসে কিছুটা কষ্ট অনুভব করছিলাম। তাই কয়েকটা জায়গায় থেমে থেমে উঠলাম। পর্বত-টা মূলত বরফে ঢাকা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে লাল মাটি এবং সবুজ ঘাস দেখা যায় বরফের ফাঁকে ফাঁকে।
সেদিন কলোরাডো শহরেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে হোটেলে ফিরে আসলাম।
তৃতীয়দিন সকালেই রওয়ানা দিলাম ওয়াইয়োমিং এর জ্যাকসন শহরের উদ্দেশ্যে। কলোরাডো স্প্রিংস থেকে ডেনভার হয়ে উত্তর দিকে ইন্টারস্টেট ২৫ (আই-২৫) হাইওয়ে ধরে এবং পরবর্তীতে আই-৮০ ধরে জ্যাকসন যাওয়া যায়, তবে আমরা বেছে নিলাম প্রথমে পূর্ব দিকে রকি মাউন্টেইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আই ৭০, ইউ এস ৩৪ এবং ইউ এস ৪০ রুট। আগেই অনলাইনে বিভিন্ন পেইজে খোঁজাখুঁজি করে জেনেছি যে এই রাস্তায় গেলে কলোরাডো’র সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় সবচেয়ে বেশি, এবং সেটা সেদিন বুঝতে পেরেছি আমরা। কিছুটা তুষারপাত আর বৃষ্টি থাকলেও, আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক ছিল। এই পথের বিভিন্ন স্থানে থেমে উপভোগ করলাম কলোরাডো’র স্নিগ্ধ সুন্দর প্রকৃতি। কলোরাডো নদী’র উৎসের কাছাকাছি গ্রেট লেক এবং লেক গ্র্যানবি দেখলাম, যদিও বরফে পানি অধিকাংশ জমে ছিল, তারপরও বেশ সুন্দর লেগেছে।

লেইক গ্র্যানবি থেকে আই-৪০ ধরে ক্রেমলিং এর দিকে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ পরপরই রাস্তার পাশে দেখা যাচ্ছিল কলোরাডো নদী। আমরা স্থানে স্থানে বিরতি নিয়ে এই নদী’র সৌন্দর্য দেখলাম। নদীর পাড়ে লাল-লাল গুল্মজাতীয় গাছ এবং আশেপাশে’র সবুজ ঘাস-সমৃদ্ধ তৃণভূমি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি করেছে।আই-৪০ ধরে ক্রেইগ শহর পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে উত্তর দিকে কলোরাডো-১৩ রাস্তা ধরে ওয়াইয়োমিং এর বর্ডারের দিকে এগুলাম।

ওয়াইয়োমিং এর বর্ডারের শহর ব্যাগস্‌ এ পৌঁছাতেই সম্মুখীন হলাম ভারী তুষারপাতের। কিছুক্ষণ পর অবশ্য সেটা থেমে গিয়েছিল।

সেই রাস্তায় আমাদের গাড়ি ছাড়া উত্তর দিকে অন্য কোনো গাড়ি দেখিনি অনেকক্ষণ। দুইপাশে কোনো বাড়িঘরও নেই যতদূর চোখ যায়। আই-৮০ তে উঠে সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে আমরা পৌঁছুলাম রক-স্প্রিংস নামক শহরে। পথে প্রতিটা বড় শহর দেখে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। তাই সেখানে একটা গীর্জার পার্কিং এ গাড়ি রেখে কিছুক্ষণ আশপাশটা দেখলাম। মাগরিবের নামাজ গীর্জা’র উঠানে পড়ে রওয়ানা দিলাম জ্যাকসন শহরের উদ্দেশ্যে।

ইউ এস - ১৯১ রাস্তা ধরে কিছুদূর এগুনোর পরই সন্ধ্যা নেমে এলো। দূরে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য হারিয়ে গেলেও গোধুলি’র আলোর ছটা মিলিয়ে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগলো। এতক্ষণ আবহাওয়া বেশ ভালো ছিল। পাইনডেইল শহরে পৌঁছানো’র আগেই আবার শুরু হল তুষারপাত। আরও কিছুটা সামনে যেতেই সেটা তুষারঝড় -এ রূপান্তরিত হল। ততোক্ষণে রাত প্রায় সাড়ে নয়টার বেশি বেজে গিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এইসব রাস্তায় রাত নয়টার পর বরফ পরিষ্কার করার গাড়ি আসে না। এই অবস্থায় এই তুষার-ঝড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বেশ বিপদজনক ছিল। তারপরও আর মাত্র ঘন্টাখানেক গাড়ি চালালেই হোটেলে পৌঁছাতে পারবো এই আশায় এগুতে লাগলাম। আরও কিছুদূর এগুনোর পর রাস্তা পুরোটা বরফে ঢেকে গেল। অন্ধকারে রাস্তা’র সীমানা বোঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো কোনো কোনো স্থানে। বীমার (উঁচু হেডলাইট) জ্বালিয়ে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু বীমার দেয়ায় অতিরিক্ত আলো শুভ্র তুষার থেকে প্রতিফলিত হওয়ায় সামনে দেখতে আরও বেশি সমস্যা হচ্ছিল। আলো কমিয়ে আস্তে আস্তে এগুনোর চেষ্টা করালাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর উল্টা দিক থেকে একটা গাড়ি এসে অতিক্রম করায় সেই গাড়ির চাকার দাগ দেখে দেখে রাস্তা ঠাহর করে এগুলাম বেশ কিছুদূর। এরপর পেলাম আমার সামনে একটা গাড়ি - একই দিকে যাচ্ছে। সেটার চাকার দাগ দেখে বাকি রাস্তা গেলাম। রাত এগারোটার দিকে হোটেলে পৌঁছে স্বস্তি’র নিঃশ্বাস ফেললাম।

রাতে ইয়েলোস্টোন যাওয়ার পথ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম বরফজনিত প্রতিকূলতার কারণে এই সময় ইয়েলোস্টোন এ যাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ থাকে। তাই পরদিন জ্যাকসন শহরের কাছেই গ্র্যান্ড টিটন ন্যাশনাল পার্কে গেলাম। গ্র্যান্ড টিটন পাহাড়-লেক বনভূমি সমৃদ্ধ বেশ সুন্দর একটা ন্যাশনাল পার্ক। তবে আমরা যে সময় গিয়েছিলাম তখন লেকটা বরফে ঢাকা ছিল।

অল্পসময় সেখানে বেড়ানোর পড় দুপুরের আগেই রওয়ানা দিলাম আইডাহো’র উদ্দেশ্যে। গ্র্যান্ড টিটন হাইওয়ে ( ইউ এস ২২) এর পাহাড়ি রাস্তা ধরে ভিক্টর শহরের এর মধ্য দিয়ে ওয়াইয়োমিং থেকে আইডাহোর পথে এগুনোর সময় প্রথম দেখা হল সাপ নদী (Snake River) - এর সাথে। এই সাপ নদী পরবর্তী প্রায় দুইশত মাইল আমাদের পাশে পাশেই ছিল।

পাহাড়ি রাস্তা আইডাহো-৩১ থেকে সমতলে নেমে ইউ-এস ২৬ এ উঠার আগে গাড়ির তেল নেয়ার জন্য থামলাম সোয়ান ভ্যালীস্থ রেইনী-ক্রিক স্টোর-এ। গাড়িতে তেল নিয়ে এবং সেই দোকানের পৃথিবীবিখ্যাত বর্গাকৃতি’র আইসক্রিম খেয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশের সবুজ প্রকৃতি দেখে আবার যাত্রা শুরু করলাম।

আইডাহোতে ঢুকার পরপরই ওয়াইয়োমিং এর বরফ-জমা সাদা প্রকৃতি সবুজ হয়ে গেল। সমতলভূমিতে আসার পর দেখলাম বিস্তৃত এলাকা জুড়ে খেতখামার। অনেক স্থানে এখনও চাষ শুরু হয়নি, জমি নিড়ানো চলছে বিশাল বিশাল ট্রাক-হো দিয়ে। কিছু কিছু স্থানে জমিতে পানি দেয়া হচ্ছে বিশাল বিশাল ওয়াটারিং হুইল দিয়ে।

আইডাহো ফলস্ নামক শহরে পৌঁছুলাম সন্ধ্যার আগে। রাজধানী-শহর ‘বয়জ’ এর পর আইডাহোর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এটা। শহরের ঠিক কেন্দ্রেই বিশাল জলপ্রপাতটির অবস্থান। সেই সাপ নদীতে বাঁধ দিয়েই এটা বানানো হয়েছে। নদীর পাড় ঘেঁসে যাওয়া গ্রীনবেল্ট ট্রেইল এ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমরা আবার রওয়ানা দিলাম আমাদের গন্তব্য টুইন ফলস শহরের উদ্দেশ্যে।

যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্থানে থেমে সাপ নদী’র তীরে আরও কিছু সময় কাটালাম। বেশ খরস্রোতা এবং টলটলে স্বচ্ছ পানি। একদম হিমশীতল হওয়ায় পানিতে নামার উপায় ছিল না। কোনোমতে হাতমুখ ধোয়া যায় অল্প অল্প পানি হাতে নিয়ে।

টুইন ফলস-এ এয়ার-বি-এন-বি’র মাধ্যমে ভাড়া করেছিলাম একটা রুম। অল্পবয়সী এক দম্পতি তাদের বাড়ি’র দোতলার দুইটা ঘর ভারা দিচ্ছে - তার একটায় আমরা উঠলাম। খুব নির্জন এলাকা। কাঠের বাড়িতে হাঁটলে ক্যাঁচক্যাঁচ করে যে শব্দ হয় সেটা খুব কানে লাগে। অবশ্য রাতে ঘুম ভালোই হয়েছে আমাদের। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা বের হওয়ার সময় বুঝলাম সেই দম্পতি ইতিমধ্যে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে। আমরা আমাদের জিনিসপত্র সব নিয়ে একবারে বের হয়ে গেলাম। টুইন ফলস্‌ এর মূল আকর্ষণ সোশোন ফলস্‌ দেখতে গেলাম দুপুর নাগাদ। এতো বিশাল এবং শক্তিশালী জলপ্রপাত আর কখনো দেখিনি। পানির ঝাঁপটায় যে বাষ্প তৈরি হয়েছে তার মধ্যে বিশাল এক রঙধনু দেখা যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ সেখানে অবস্থান করে এই অপরূপ দৃশ্য দেখলাম।


এরপর রওয়ানা দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সল্ট-লেক সিটি’র উদ্দেশ্যে।
ইন্টারস্টেট-৮৪ থেকে ইন্টারস্টেট-১৫ উঠার সময় থেকেই পূর্ব দিকে চোখে পড়লো বিশাল বিশাল পর্বতশ্রেণী। এই পর্বতশ্রেণী-গুলা পরবর্তীতে ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তের কাছাকাছি পর্যন্ত আমাদের পাশে ছিল। সকালে তাড়াতাড়ি রওয়ানা হওয়ায় আমরা বিকাল নাগাদ পৌঁছে গেলাম সল্ট লেক এ।



সল্ট লেকের  কাছেই এন্টিলোপ আইল্যান্ড নামক এক দ্বীপে ঠুকলাম। আইল্যান্ড বলা হলেও, এটা পুরোপুরি দ্বীপ না। দক্ষিণ দিক মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত। এখানকার মূল আকর্ষণ লেক এবং পর্বতগুলার সুন্দর দৃশ্য এবং দ্বীপের ভিতর কিছু বন্য প্রাণী। লেকের মধ্য দিয়ে টানা প্রায় ছয় মাইল দীর্ঘ একটা রাস্তা দিয়ে দ্বীপে ঢুকতে হয়। আমরা কিছু বাইসন এবং হরিণ-সদৃশ এন্টিলোপ ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। এছাড়া অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কোটি কোটি বিশাল আকৃতির মশা। ছয় মাইলের ওই রাস্তায় পঞ্চাশ মাইল বেগে গাড়ি চালানোর সময় হাজারখানেক মশা গাড়ির উইন্ডশিল্ডে ধাক্কা খেয়ে বেঘোরে মারা পড়ল। সেদিনই মূলত আমাদের সল্ট লেক দেখা শেষ। এখানে আর কোনো কিছু ঘুরে দেখার পরিকল্পনা ছিল না। তবে সেদিন রাতে হোটেলে যাওয়ার পর বসে বসে সল্ট লেক সিটি’র অন্যান্য আকর্ষণগুলা খুঁজে দেখছিলাম। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত মর্মনদের ঐতিহাসিক গীর্জা টেম্পল স্কয়ার দেখার পরিকল্পনা করলাম।

সল্ট লেকের দক্ষিণ তীরে এই বাসাটাও এয়ার-বি-এন-বি’র মাধ্যমে ভাড়া করা। কেসলার পর্বতের একদম গোড়ায় এই বাসার বেইজমেন্টে বেশ কয়েকটা রুম সুন্দর করে সাজানো আছে। এর মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম “বাচ্চাদের রুম” - যাতে তিনটা সিঙ্গেল বেড পেতে রাখা ছিল। এখানেও মরিয়ম আরেক দফা খিচুড়ি রান্না করে ফেললো। বাইরের খাবার আমাদের বেশিদিন পোষায় না। ডাল+ভাত খেতে মন চায়। আমার ছেলেও ঘরে রান্না খাবার ছাড়া তেমন কিছু খেতে চায় না।

আমাদের ভ্রমণ মূলত এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন ফিরতি পথে যা কিছু দেখব সেগুলা বোনাস। পথে সামান্য অতিরিক্ত কিছুটা রাস্তা পেরিয়ে ঘুরে এলাম ব্রাইস ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক-এ। খুব বেশি সুন্দর মনে হয়নি আমার কাছে এই পার্ক।


ফিরতি পথ অনেক লম্বা হওয়ায় সরাসরি সল্ট লেক সীটই থেকে টেম্পিতে আমাদের বাসায় না এসে আমরা মাঝখানে একটা যাত্রা-বিরতি দিলাম জুয়া’র শহর লাস-ভেগাস এ। এখানে যাত্রা বিরতি নেয়ার মূল কারণ হোটেল ভাড়া কম। এছাড়া অন্য পথ দিয়ে (গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পশ্চিম পাশ দিয়ে ঘুরে) যেতে যে সময় লাগতো, প্রায় একই সময় লাগে লাস ভেগাস হয়ে টেম্পি যেতে। পশ্চিম পাশটা আগে একবার ভালোভাবে ঘুরে দেখেছিলাম, তাই এইবার আর সেদিকে গেলাম না। লাস ভেগাস এ গিয়ে মূলত ঘুমালাম। অবশ্য আমার ছেলেকে নিয়ে এক ফাঁকে স্ট্রিপে একবার একটু ঢু মেরে এসেছি ঘন্টাদেড়েকের জন্য।

পরদিন লাস ভেগাস থেকে ফেরার পথে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এ চলে গেলাম। এই সিদ্ধান্ত সেদিন সকালেই নিয়েছি। এই সফরে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু যেহেতু পুরো একটা দিন হাতে ছিল, সেটা দেখে আসাই উচিৎ বলে মনে হল। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিশালত্ব এবং সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না, এমনকি ছবি তুলেও প্রকাশ করা সম্ভব না।
ফিরতি পথে ফ্ল্যাগস্ট্যাফে ছোট্ট একটা যাত্রা বিরতি নিয়ে রাত ১১ টার দিকে আমরা টেম্পিতে ফিরলাম।