রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০২৩

গভীর রাতের আড্ডা

টা বছর সময় এরিজোনার টেম্পি শহরে বসবাসের পর সেখান থেকে অরিগন এর পোর্টল্যান্ড মুভ করতে বেশ কষ্ট হয়েছে। মানসিকভাবে আমি সম্ভবত: এখনও পুরাপুরি মুভ করতে পারি নাই। মন পড়ে থাকে টেম্পি' কাঠফাটা পিচগলা পথে, গ্যাস-ষ্টেশনে কিছুদিন পরপর বিভিন্ন ছুতায় ফিরে ফিরে যাই অতি প্রিয় কিছু মানুষের টানে, প্রিয় টেম্পি শহরের টানে। পুরাতন মানুষজনের পাশাপাশি প্রতিবার পরিচয় হয় কিছু নতুন নতুন মানুষের সাথে, আর তাঁদের একেক জনের গুণের বহর দেখে আমি আশ্চর্য হই।

এমনই কোনো এক টেম্পি সফরে কোনো এক গভীর রাতের আড্ডায় দুইজন গুণী মানুষের সুপ্ত প্রতিভার পরিচয় পাই। সেবার টেম্পি থেকে ফেরার পথে বিমানে বসে তাঁদের স্মরণে লেখা এই কবিতা।


***


বিমান গগণে সবে মেলিয়াছে পাখা,

নিভায়েছে বাতি তার তুলিয়াছে চাকা,

বাঁধনে জড়ায়ে সিটে তশরীফ রাখা।


বাহিরে চাহিয়া দেখি টেম্পির হাতছানি,

স্মরণে আসিলো এক শায়ের, আল-"আহসানী",

তার সাথে কতিপয় কৌতুক "হাসানী"


কাতুকুতু দিলো রস আদি, সর্বনাশী!

বদন কাঁপায়ে এলো বেদমক হাসি।

যতোই চাপিতে চাই,

ততোই বাড়িয়া যায়।

যাত্রীরা আঁড়চোখে দেখে ডানে বামে,

তথাপি সে হাসি মোর মোটে নাহি থামে।


হেনকালে এলো কাছে বিমানের বালা,

বালা নয়, তিনি যেন জাদরেল খালা,

কষ্টে-সৃষ্টে দিনু হাসি-মুখে তালা।



মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩

হুড-টু-কোস্ট - ২০২৩

 ২০২২ এর জুলাই -এ ওরেগণ আসার পর যখন শুনলাম এইখানে একটা ইভেন্ট হয় যেখানে লোকজন মাউন্ট হুড থেকে একটানা দৌঁড়ে ~২০০ মাইল দূরে সাগর-পাড় পর্যন্ত যায়, তখন এইটাকে পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নাই। আমার পাগল মন এই পাগলামি স্বচক্ষে অবলোকন করার এবং স্বশরীরে অনুভব করার লোভ সামলাতে পারলো না। এই কঠিন প্রোজেক্ট ‘পায়ে’ নেয়ার জন্য মন পুরোপুরি প্রস্তুত হলেও আমার দশাসই, বিশালবপু শরীরের প্রস্তুতিহীনতার বহর সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠছিল আমার XXL সাইজের ঢোলা-ঢালা গেঞ্জি ভেদ করে। মিকি’র মাধ্যমে পরিচয় হলো মাহফুজ এর সাথে। মাহফুজ ২০২২ এ এই দৌঁড় এ অংশগ্রহণ করেছে। Hood to Coast 2023 -এ অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সে তার দল The Broken Bunch - এর জন্য লোক খুঁজছিল। আমি আগ্রহ প্রকাশ করায় সে আমাকে তাদের দল এ অন্তর্ভুক্ত করে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিল।

প্রায় ১০ মাস প্রস্তুতি নেয়ার পর শুক্রবার ২৫ আগস্ট ভোর আড়াইটায় শুরু হলো আমাদের দৌঁড়। মাউন্ট হুড এর টিম্বারলাইন লজ এর সামনে থেকে প্রতিটা দলের দৌঁড় শুরু হয়। একেক দল একেক সময় দৌঁড় শুরু করে। রেজিস্ট্রেশনের সময় দলের সবার গতি জানাতে হয়। দলের সদস্যদের গড় গতি’র উপর ভিত্তি করে HTC কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে সেই দল কখন শুরু করবে। স্বল্প-গতি’র দল আগে শুরু করে, দ্রুত-গতি’র দল পরে শুরু করে যাতে সবগুলা দল মোটামুটি একই সময়ে গন্তব্যে পৌঁছায়।

অন্যান্য রিলে দৌঁড় এর মতো এখানেও দলের একজনের দৌঁড় শেষ হওয়ার পর পরবর্তি জন দৌঁড়ায়। মোট ৩৬ টা ‘লেগ’ (Leg) এ ভাগ করা পুরাটা পথ। ৪-৮ মাইল এর মতো প্রতিটা লেগ এর দূরত্ব। একেকটার কাঠিন্য-স্তর একেক রকম। কোনোটা সহজ, কোনটা কঠিন। কিছু লেগ কঠিন দূরত্বের কারণে, কিছু কঠিন পাহাড়ি রাস্তার চড়াই উৎরাই এর কারণে। কিছু লেগ কঠিন দুপুরের গরম এর কারণে, কিছু লেগ কঠিন কারণ সেগুলায় পিচ-ঢালা পথের পরিবর্তে নুড়িপাথর বিছানো পথে দৌঁড়াতে হয়। দলের সদস্যদের দক্ষতা বিচার করে দলনেতা সিদ্ধান্ত নেয় কাকে কোন লেগ দৌঁড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হবে।

সাধারণত ১২ জনের দল দুইটা Van -গাড়িতে ভাগ করা থাকে। Van 1 -এর ছয়জন প্রত্যেকে  একটি করে লেগ দৌঁড়ায়, তারপর অপেক্ষমাণ Van 2 দৌঁড় শুরু করে। Van 1 -তখন বিশ্রাম নেয় এবং অপেক্ষা করে Van 2 এর দৌঁড় শেষ হওয়ার জন্য। এইভাবে প্রতিটা ভ্যান এর সবাই ৩ বার করে দৌঁড়ায়।

Exchange Point 27 -এ অপেক্ষারত বিভিন্ন দল এর Van 1

Exchange Point 18 - এ The Broken Bunch দলের সদস্যরা


আমাদের দল এর সাকিব এবং দলনেতা ফুয়াদ ব্যাতিত বাকি সবাই প্রথমবারের মতো এই দৌঁড় এ অংশগ্রহণ করেছি। ফুয়াদ এবং  সাকিব ২০২২ এর HTC- শেষ হওয়ার পর (নামকরণের স্বার্থকতা প্রমাণ করে) ভেঙ্গে যাওয়া The Broken Bunch দলের অবশিষ্ট দুই সদস্য। মাহফুজ যদিও নিজে শেষ পর্যন্ত আর আমাদের সাথে দৌঁড় এ অংশ নিতে পারেনি, কিন্তু দলগঠনে এবং প্রস্তুতি নিতে সর্বাত্মক সাহায্য করেছে।

আমাদের দলের সদস্যদের বেশিরভাগই ওরেগণ এর বাহির থেকে এসেছে HTC-তে অংশগ্রহণ করার জন্য। দলনেতা ফুয়াদ-সহ আরও কয়েকজন এসেছে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য থেকে, ওসমান মামুন এসেছে অস্টিন (টেক্সাস) থেকে, রেজা এসেছে ক্যালিফোর্নিয়ার বে’ এরিয়া থেকে। দৌঁড়ের পুরাটা সময় মূলত নিজের Van 1 এর সদস্যদের সাথেই বেশি সময় কাটানো হয়েছে আমার। আমিনুল জেম ছাড়া এদের কারো সাথেই আগে থেকে পরিচয় ছিল না, কিন্তু এই ইভেন্ট এর মাধ্যমে ভালো সখ্যতা তৈরি হয়েছে।

দলনেতা হিসাবে ফুয়াদ আমাদেরকে পুরা সময় যেইভাবে গাইড করেছে সেইটা প্রশংসনীয়। আমাদের দলের অধিকাংশেরই নিয়মিত দৌঁড়ানোর অভ্যাস নেই - এটা সে ভালোভাবেই জানে, তাই দ্রুত শেষ করার কোন তাড়া সে আমাদের দেয় নি। শুধু সুস্থভাবে শেষ পর্যন্ত গন্ত্যব্যে পৌঁছানোই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য - এটা সে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে।

Sea Side - এ The Broken Bunch দলের সদস্যরা

মাউন্ট হুড এর টিম্বারলাইন লজ থেকে ‘সি-সাইড’ এর সাগরপাড়ে পৌঁছাতে আমাদের দল এর সময় লেগেছে ৩৮ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট; ১১৬৪ -টি দল শেষ করতে পেরেছে পুরা দৌঁড়, তার মধ্যে আমাদের স্থান ১১৫৮ (শেষ দিক থেকে ষষ্ঠ হয়েছি আমরা)। তেমন গর্ব করার মতো কোন টাইমিং না, কিন্তু আমরা শেষ করতে পেরেই খুশি। দৌঁড় শেষে সি-সাইড এ পৌঁছে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখে সবার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সেখানে গিয়ে জানলাম বাংলাদেশি বিশিষ্ট “বিজনেস-টাইকুন” মাসুদুর খান ভাই তাঁর সি-সাইড এর বেশ কয়েকটি বাড়ির একটি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন HTC দৌঁড় শেষ করে আসা বাংলাদেশি দলগুলার বিশ্রাম নেয়ার জন্য। তাঁর আন্তরিক আতিথেয়তায় আমরা সবাই মুগ্ধ। দুইদিনের দৌঁড়ের পর ঘাম-চ্যাটচ্যাটে অবস্থায় মাসুদ ভাইয়ের বাসায় গরম পানিতে শাওয়ার নিয়ে আমাদের কেউ কেউ এটাকে জীবনের সেরা গোসল হিসাবেও আখ্যায়িত করলো।


এই দৌঁড় এ অংশগ্রহণ এর মাধ্যমে অনেকগুলো বিষয় শিখেছি।

১) অল্প হলেও নিয়মিত অনুশীলন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি গত দশ মাসে অনিয়মিতভাবে অনুশীলন করেছি, কোনো সপ্তাহে দুই তিনবার দৌঁড়ানোর পর পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ আর হয়তো দৌঁড়ানো হয় নি। এতে আমার পারফর্ম্যান্স এ আহামরি কোনো উন্নতি হয় নি। আগেও 5mph গতিতে দৌঁড়াইতাম, এখনও সেভাবেই দৌঁড়াই।

২) বাহ্যিক দৈহিক  আকৃতি দেখে মানুষের দক্ষতা বোঝা যায় না সবসময়। HTC -তে আমি 16.5 মাইল এর মত দৌঁড়েছি, একবারও অন্য কোনো দলের কোনো দৌড়বিদকে আমি অতিক্রম করতে পারি নাই, কিন্তু আমাকে অতিক্রম করে গিয়েছে শতশত মানুষ। অতিক্রম করে যাওয়ার সময় আমার সারা শরীরে ক্লান্তি এবং ধীর গতি লক্ষ্য করে অনেকেই “তুমিই পারবে”, “Keep it up”, “Way to go” ইত্যাদি উৎসাহমূলক কথা বলে যাচ্ছিল। এঁদের অনেককেই অন্যত্র দেখলে আমি হয়তো ধরে নিতাম সে আমার চেয়ে নিশ্চয়ই ধীরে দৌঁড়ায়।

৩) এই ধরণের ইভেন্ট এ রাস্তাঘাটে ভিড় হয় অনেক। যেইখানে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে বলে মনে হয়, সেইখানে অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রওয়ানা দেয়া উচিৎ। টয়লেট এর সামনেও অনেক ভিড় হতে পারে, এবং অনিয়মিত ঘুম এবং খাওয়া-দাওয়ার ফলশ্রুতিতে দৌঁড়ের ঠিক আগ-মুহূর্তে উত্তেজনায় “২ নাম্বার” চাপতে পারে। অতএব খাবার নিয়ে কোনো ধরণের এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে না দৌঁড় এর দিন।

৪) নিজের সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখা বেশি জরুরী। আবহাওয়া খারাপ হলে সেই অনুযায়ী গতি কমিয়ে, প্রয়োজনে বিশ্রাম নিয়ে নিজেকে সামলে নিতে হবে।

৫) দৌঁড়ানোর সময় “সিঙ্গারা” নয়, ‘বক্সার’ পরিধান করতে হবে।

৬) দৌঁড়ানোর সময় উপযুক্ত গেঞ্জি না পরলে পুরুষ মানুষের বক্ষাগ্র-দ্বয় এ ব্যাথা হইতে পারে, রক্তক্ষরণও হওয়া অসম্ভব নয়। HTC শুরুর আগের রাতে হোটেলে আমাদের একজন তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা শেয়ার করার পর আমরা বাকিরা সবাই তাকে নিয়ে অনেকক্ষণ হাসাহাসি করলাম। পরেরদিন প্রচণ্ড গরমে দৌঁড় শেষ করে এসে আমাদের ষষ্ঠ দৌঁড়বিদ জানালো তার বক্ষাগ্র-দ্বয় জ্বালাপোড়া করছে।

আমাদের দলের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। বিশেষ ধন্যবাদ Fuad Nur Taufique, শেষ পর্যন্ত ধৈর্য সহ আমাদেরকে গাইড করার জন্য। ধন্যবাদ Touhid Zaman এবং তার পরিবার-কে আমাদের দুই বেলার খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা করার জন্য। ধন্যবাদ স্বজন এবং তার স্ত্রী-কে, তাদের বাসা-টা আমাদেরকে নিজের বাসার মতো ব্যাবহার করতে দেয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে ঘন্টা-দুইয়েক এর বিশ্রাম অনেক জরুরী ছিল। 

Ai Michael এবং Mahfuzur Rahman -কে ধন্যবাদ The Broken Bunch -এ যোগ দেয়ার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য।

ধন্যবাদান্তে

"ষষ্ঠ দৌঁড়বিদ"


Hood to Coast 2023 results

লেখাটি ফেসবুকে আমার এই পোস্ট -থেকে নেয়া।

শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৩

ফোর পিক্‌স

মাঝরাতে দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলল ফজলে। দরজা খুলে দেখল তারিক দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে একটা ঝোলা-টাইপ ব্যাগ।

দরজা খুলতেই তারিক হড়বড় করে বলা শুরু করলোঃ "এই ফজলে, তোমারে এতবার কল দিতেছি, ফোন ধরো না কেন?" 

ফজলেঃ "ভাই, এখন তো রাত তিনটা বাজে... ।"

তারিকঃ "তিনটা বাজে তো কী হইছে? তোমার আর আমার না পাহাড়ে উঠার কথা, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হও। ব্রাউন্স পীক-এ যাব। এইটা নাকি মারিকোপা কাউন্টি'র সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। সকাল সকাল রওয়ানা দিতে হবে, নাহয় রোদ উঠে গেলে ওঠা কঠিন হবে।"

ফজলে বললোঃ তারিক ভাই, আজকে না গেলে হয় না? ঘুমটা ঠিকমতো হয় নাই... ।

তারিক তার কথা শেষ করতে দিলো নাঃ "আরে মিয়া ঘুমাইতে তো পারবা সারাজীবনই, আজকে বন্ধের দিন, দেরি না করে বের হও।"

ফজলেঃ "আর কেউ যাবে ভাই? নাকি শুধু আমরা দুইজনই...?"

তারিকঃ "আর কেউ এখনও কনফার্ম করে নাই, তবে দেখি আরও দুই একজনকে ফোন দিব। কমল-কে অনলাইনে দেখাচ্ছে, কিন্তু কল দিচ্ছি রিসিভ করে না...। মনে হয় গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতেছে।"

আরও কিছুক্ষণ গাঁই-গুই করে ফজলে শেষমেশ রাজি হয়ে রওয়ানা দিল।

... ... 

... ... 

এরপর পাহাড়ে উঠার শুরুর দৃশ্য, ট্রেইলের গোড়ায় পানি, ব্যাগ ইত্যাদি গুছিয়ে খুব আগ্রহের সাথে ফজলে-কে তাড়া দিয়ে আগে আগে হাঁটা শুরু করলো তারিক।

১৫-২০ মিনিট পরের দৃশ্য। ট্রেইলের পাশে গাছের নীচে পাথরের উপর পাছা ঠেকিয়ে বাঁকা হয়ে বসে আছে তারিক। জিহ্বা আধা-হাত বের হয়ে গেছে।সারা শরীর ঘামে ভিজা। মাথা বেয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছে। 

পাশে দাঁড়িয়ে ফজলে বলছে, "ভাই, ট্রেইল তো মাত্র শুরু, আরও অনেক রাস্তা বাকি ... এখনই বসে পড়লেন যে... ?"

তারিক হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোমতে বললঃ "আজকে রোদের কী মারাত্মক তেজ দেখছো? আরও ভোরে রওয়ানা দেয়া দরকার ছিল।...  ঘেমে শরীরের পানি সব বের হয়ে যাচ্ছে।... এইভাবে চললে কিছুক্ষণ পর শুকনা তেজপাতার মতো গাছের নিচে পড়ে থাকতে হবে।... তখন আমার এতো বড় বডি তো তুমি কাঁধে তুলে নামাইতে পারবা না। চলো আজকে ফিরে যাই। আরেকদিন ঠাণ্ডা আবহাওয়া দেখে আবার আসবো।" 

ফজলেঃ "কী বলেন ভাই? আপনিই তো মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসলেন। এখন বলতেছেন ফিরে যাইতে? এক কাজ করেন, আপনি এইখানে বিশ্রাম করেন, আমি উপর থেকে ঘুরে আসি।"

তারিকঃ "না না, একা একা যাবা কেন? আমি অনলাইনে এই ট্রেইলের রিভিউ পড়েছি, সাপ-টাপ আছে, র‍্যাটেলস্নেক...। তাছাড়া দুই একজন নাকি ভাল্লুক-ও দেখেছে। একা যাইয়ো না। চলো আজকে ফিরে যাই।"

... 

আরও কিছুক্ষণ বাত-বিতন্ডা শেষে চরম বিরক্ত হয়ে ফিরতি পথ ধরলো ফজলে। 

(টেম্পি-রেচার নাটকের একটা দৃশ্য)

মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১

হাতের লেখা

জানি না এখনকার স্কুলে বাচ্চাদের হাতের লেখার সৌন্দর্যের উপর কতোটা গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সুন্দর হাতের লেখা / হাতের সুন্দর লেখা আমাদের সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল। 

পরীক্ষায় শিক্ষকদের মন ভোলানোর একটা বড় হাতিয়ার ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার হাতের লেখা।

ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত আমার হাতের লেখা ছিল আক্ষরিক অর্থেই "কাউয়ার ঠ্যাঙ, বগার ঠ্যাঙ"। ষষ্ঠ শ্রেণীতে হুমায়রা ম্যাডামের স্কেলের বাড়ি খেয়েছিলাম, খাতায় আমার বিচ্ছিরি লেখা ম্যাডাম পড়তে পারছিলেন না এই কারণে। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম হাতের লেখা ঠিক করতে হবে। ঠিক করলাম ক্লাসে যাদের হাতের লেখা সুন্দর তাদের লেখা নকল করবো। তখন থেকে মেট্রিক পাশ করা পর্যন্ত আমি সম্ভবত ৩০ থেকে ৪০ জনের হাতের লেখা নকল করার চেষ্টা করেছি। প্রথমে শুরু করেছিলাম আমার আব্বার হাতের লেখার মতো লিখতে, সেটা ওই বয়সে বেশ কঠিন মনে হলো, কারণ আব্বার হাতের লেখা ছিল টানা-টানা। এরপর ওবায়দুরের হাতের লেখার মতো লিখতে চেষ্টা করলাম, তারপর কিছুদিন পল্লব এর হাতের লেখা, তারপর ওসমান গণীর "ছাপা অক্ষরের" লেখা। আবদুল্লাহ আল আমিন (মাসুম) এর হাতের লেখাও সুন্দর ছিল, ওইটাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। ক্লাস সেভেন বা এইটে খেয়াল করলাম ফয়সাল বিন হাশেম এর হাতের লেখা অনেক সুন্দর, তৃপ্তি ম্যডাম সার্টিফাই করেছিলেন যে ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দর লেখা ফয়সাল বিন হাশেম এর, তাই ওইটাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। নবম/ দশম শ্রেণীতে জাসেম আল লতিফ আর মইনুদ্দিন চিশতী'র হাতের লেখা নজর কাড়লো, দুইজনের লেখা অনেকটা একই রকম, ছোট ছোট হরফে লিখতো। সেটাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। আব্দুল্লাহ (বাচ্চু)র হাতের লেখা অবিকল ওসমান এর লেখার মতো ছিল। সেটাও আবার কিছুদিন ট্রাই করলাম।

এদের সবার হাতের লেখা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। এতো বেশি চেষ্টা করেছি...।

এতো ঘনঘন হাতের লেখার ফরম্যাট বদলানোর ফলশ্রুতিতে আমার হাতের লেখা দেখতে আগের মতো দূর্বোধ্য আর রইলো না, কিন্তু গতি অনেক কমে গেলো। পরীক্ষায় আর ফুল আনসার করতে পারি না।

এস এস সি'র টেস্ট পরীক্ষার পর মাস দুইয়েক একটা নির্দিষ্ট হাতের লেখা স্থির করেছিলাম, সেই লেখায় উপরোক্ত অনেকের লেখার ছাপ ছিল। সেই ফরম্যাটেই মেট্রিক পরীক্ষা পর্যন্ত প্র‍্যাকটিস করে লেখার গতি কিছুটা বাড়ালাম। কিন্তু তারপরও সমাজে ফুল আনসার করতে পারলাম না। বাংলা দ্বিতীয় পত্রে টেনেটুনে শেষ করেছিলাম।

ইন্টারে উঠে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম, আব্বার হাতের লেখা নকল করার ট্রাই করলাম আবার। এবার কিছুটা সফল হলাম, জেনেটিক্স কিছুটা সাহায্য করেছে সম্ভবত এইক্ষেত্রে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটা ডায়েরিতে লিখতাম অনিয়মিতভাবে। সেটার একেক পাতায় একেক রকম হাতের লেখা ছিল। শুধু তাই না, ওই ডায়েরিতে আমার লেখা ছাড়াও আমার কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধুর লেখাও ছিল, আবুহেনা, আলাল, বাচ্চু, (শানু?), আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার হলের এক রুমমেট।  অনেক ঘটনাবহুল সময়ের স্মৃতিসম্বলিত সেই ডায়েরিটা হারিয়ে গিয়েছে।

শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

"সামাজ"

সামাজিক বিজ্ঞান পড়াইতেন আবু সাইয়্যিদ স্যার, ক্লাসে অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করতেন। মাঝে মধ্যে পড়া ধরতেন, না পারলে স্কেলের বাড়ি দিতেন হাতে।

স্যার গল্প করতে করতে ক্লাসের ৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে ৩৫ মিনিটই পার করে দিতেন। একই গল্প অনেকবার করে শুনেছি আমরা। সম্রাট আকবর এর কাহিনী, তাঁর সভাসদ বীরবল-টোডরমল - এর কাহিনী এইসব দিয়ে শুরু হইতো। আকবর এর বিশেষ একেশ্বরবাদ এর কথা বলতেন স্যার প্রায়ই। আকবর নাকি প্রজাদের পরষ্পর দেখা হলে 'সালাম' দেয়ার বদলে 'আল্লাহু আকবর' বলার প্রথা চালু করতে চেয়েছিলেন (যাতে তার নাম উচ্চারণ হয়)।  বিভিন্ন দেশের মানুষের অভ্যাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসের ধরণ এইরকম অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতেন স্যার। আমাদের খাদ্যাভাসের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা হইতো (আগে মানুষ "কচু"কে অবহেলা করতো, বলতো "কচু খাও", পরবর্তীতে দেখা গেল কচুতে আয়রন-ভিটামিন ... )।

অন্যান্য দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার ব্যাবহার এইসব নিয়েও আলোচনা হইতো। বলতেন আমরা উপমহাদেশের মানুষ ধর্মকর্ম করি শৈশবে, যৌবনে "মৌজ-মাস্তি" করি, আর বৃদ্ধ বয়েসে মরার ভয়ে আবার ধর্ম-কর্ম করি। তুরষ্কের মানুষের স্বভাব নাকি এর ঠিক উলটা। তাঁরা নাকি ধর্ম-কর্ম করে যৌবনে; বৃদ্ধ বয়সে নাকি আবার "ফূর্তি" মোড এ চলে যায় "কয়দিন আর বাঁচবো, একটু আনন্দ ফূর্তি করে নিই" এই চিন্তা করে। (এর প্রমাণ আমি কিছুটা পেয়েছি, এখানে এক তূর্কি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই দুনিয়ায় যত রকমের নেশা-দ্রব্য রয়েছে সব অন্তত একবার ট্রাই করেছে। এখন সে মদ-গাঁজা তো দূরের কথা, বিড়িতেও কখনও একটা টান দেয় না। তবে একজন মানুষের উদাহরণ দিয়ে পুরা জাতি-কে বিচার করাও উচিৎ হবে না।)

আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হতো। আফগানিস্তানকে কেন রাশিয়ার মতো মহাশক্তিও শায়েস্তা করতে পারছে না, ক্লিংটন-মনিকার প্রেমকাহিনী গুজব-নাকি-সত্যি এইজাতীয় অনেক মজার বিষয়।

যেদিন স্যার গল্প শুরু করতেন আমরা মনে মনে খুশি হইতাম, আজকে আর পড়া ধরবেন না স্যার।মাঝে মাঝে স্যারের ক্লাসে পিছনের দিকের বেঞ্চে বসতাম ইচ্ছা করেই। স্যার সামনে থেকে পড়া ধরা শুরু করলে পিছনে আসতে আসতে একবার টপিক-টা দেখে নিতাম। সমাজ মোটামুটি সহজই ছিল, গল্পের মতো। শুধু সন-তারিখ এইরকম কিছু নাম্বার একটু ভালোভাবে দেখে মুখস্থ করে নিতে হইতো, সেসময় তাৎক্ষণিক স্মরণশক্তি ভালো ছিল, কোন কিছু দেখে সাথে সাথে উগরে দিতে পারতাম, পরদিন আর সেটা মনে থাকতো না। এই অভ্যাস সম্ভবত গড়ে উঠেছে বছরের পর বছর শুধুমাত্র পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে পরদিন পরীক্ষার খাতায় "সব-কিছু" লিখে দিয়ে আসার আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে।

ক্লাস সিক্স বা সেভেন এ সম্ভবত তৃপ্তি ম্যাডাম পড়াতেন সামাজিক বিজ্ঞান। আমরা এই বিষয়টাকে 'সমাজ' নামে ডাকলে তিনি রাগ করতেন, বলতে, এটা 'সমাজ' না, 'সামাজ'।  ম্যাডাম পড়ার বাইরে কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করতেন কি-না এখন আর মনে করতে পারছি না। করে থাকলেও হয়তো এতো মজাদার কিছু ছিল না সেগুলা। তবে ম্যাডাম ক্লাসে এসে ফ্যান বন্ধ করে জানালাগুলা সব খুলে দিতে বলতেন এইটা মনে আছে।

আমাদের ব্যাচ থেকে ২০০১ সালে সমাজে এস এস সি-তে এ+ পেয়েছে সম্ভবত মাত্র একজন (রেজাউল হায়াত)। আমাদের লিজেন্ড ছাত্র বেচারা ওসমান গণী-ও পায় নাই, যাকে তৃপ্তি ম্যাডাম একবার ১০০-তে ১০২ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বাংলায় সম্ভবত পুরা স্কুল থেকে কেউ এ+ পায় নাই সেইবার, পাইলেও আমি জানি না, চট্টগ্রাম বোর্ডেই হাতে গোনা কয়েকজন পেয়েছিল।

গ্রেডিং সিস্টেমের প্রথম ব্যাচ, তাই সবাই সব বিষয়ে সমানভাবে গুরুত্বও দেয় নাই। আবার যেসব শিক্ষক খাতা কেটেছেন তাঁরাও সমাজ-বাংলার মতো বর্ণনামূলক বিষয়ে বেশি ছাত্রকে ৮০এর বেশি নাম্বার দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

তৃপ্তি ম্যাডামের ক্লাসে না-বলা কৌতুক

ক্লাস সেভেনের ঘটনা সম্ভবত।

বিকালে খেলার মাঠে এক বড় ভাই একটা দুষ্টু কৌতুক বলেছিলেন। তেমন ভালো মানের কৌতুক না। কিন্তু ওই সময় কেন যেন সেটা আমার বেশ ভালো লাগলো, এবং আমারকচিমনে সেইটা গেঁথে গেলো বেশ ভালোভাবেই। জীবনে এর আগে যত কৌতুক শুনেছি সব কয়েকদিনের জন্য মুছে গেলো মেমোরি থেকে। সারাক্ষণই সেই একই  কৌতুক মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি থেকে থেকে দমকে দমকে হেসে উঠছি একা একাই।

এদিকে সম্প্রতি কিছু কৌতুক বলে ক্লাসেও হালকা জনপ্রিয়তা পেয়েছি আমি। ক্লাসে আনন্দ-ফুর্তি কোনো উপলক্ষ্য এলেই প্রথম দুই-চার জনের মধ্যে আমার কৌতুক বলার প্রস্তাব আসতো (মাঝে মাঝে নিজেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতাম) একদিন কোনো এক স্যার / ম্যাডাম এর অনুপস্থিতিতে রিপ্লেসমেন্ট ক্লাস নিতে এলেন তৃপ্তি ম্যাডাম। ম্যাডামের সেদিন মন বেশ ফুরফুরা। বললেন, আমরা আজকে কোনো পড়াশুনা করবো না। তোমাদের মধ্যে কেউ এসে গান গাও, বা গল্প বলো।

সেদিন আমার পাশে বসা কেউ একজন বলে উঠলো, ম্যাডাম নাসিম খুব ভালো কৌতুক বলে। ম্যাডাম আমাকে বললেন সামনে এসে কিছু একটা বলতে। আমার মাথায় তখনও আগেরদিনের শোনা সেই কৌতুক ঘুরছে, যেটা ক্লাসে বলার মতো না। আমি বললাম ম্যাডাম আজকে কিছু মনে আসছে না। কিন্তু ম্যাডাম জোরাজুরি করতে লাগলেন। ক্লাসে আরও কিছু পোলাপাইনও বলতে শুরু করলো, আরে যা, এতো ভাব নিচ্ছিস ক্যান। 

যাই হোক, অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর সামনে গেলাম। অলরেডি আমি ঘেমে গিয়েছি, পা- হালকা কাঁপছে। ম্যাডাম সাহস দিলেন, “বলো, এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?”

আমি আগেরদিন শোনা সেই কৌতুকটা বলা শুরু করলাম। প্রথম লাইন বলার সাথে সাথেই তৃপ্তি ম্যাডাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা থাকআর বলতে হবে না, গিয়ে বসো

প্রথম লাইন-টা ছিলঃ এক লোক বাজার থেকে একটা আন্ডারওয়্যার কিনে আনলো … “।