শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

স্যান ডিয়েগো সফর - ২০১৮

আমার জন্ম ২১-শে ফেব্রুয়ারি’র খুব কাছাকাছি বলেই কি-না জানি না, মাতৃভাষার ব্যাপারে আমি একটু বেশিই উৎসাহী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ‘উদযাপন’-এর ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশের মানুষ যতো আগ্রহী, অন্যান্য দেশের মানুষ ততো আগ্রহী না। তাদের কাছ থেকে আশা করাও যায় না … একে তো তারা ভাষার জন্য রক্ত দেয়নি, তার উপর এই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা-দিবস’ ব্যাপারটা’র প্রচলন হয়েছে বেশিদিন হয়নি… অনেকেই এইটার ব্যাপারে জানে না। প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান-দিয়েগো শহরে চারদিনের একটা সফরে গিয়েছিলাম। সফরসঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন দেশের ছাত্র ছিল। অনেক বলে কয়ে তাদের কয়েকজনকে শুধু “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” কথাটা তাদের নিজেদের ভাষায় বলাতে পেরেছি। তারা যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে সেটাও বুঝতে পেরেছি। নিরাপত্তা-বিষয়ক গবেষনা’র উপর কঠিন কঠিন সব কথাবার্তা (Talk) শুনিয়ে আমাদের ‘কান’ পাকানো’র মহৎ উদ্দেশ্যে ল্যাব-এর প্রফেসর-রা এই বছর গুরু-‘গাধা’ নির্বিশেষে সব পি এইচ ডি ছাত্রদেরকে মূলত ‘কান-ধরে’ই টেনে নিয়ে গেলেন Network and Distributed System Security 2018 symposium -এ। প্রফেসরদের কড়া নির্দেশঃ শুধু কান পাকালেই চলবে না, কিছুটা ‘ঠোঁটকাটা’ হয়ে সেখানে আন্তর্জাতিক-মানের যতসব গবেষক আসবেন তাঁদের সাথে জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা বলার ভান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করার যথাসাধ্য চেষ্টাও করতে হবে। শীতে কিছুটা ঠোঁট ফাঁটলেও সত্যিকার অর্থে “ঠোঁটকাটা” হয়ে আগ-বাড়িয়ে কথাবার্তা বলা আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তার উপর এতো সব বাঘা-বাঘা গবেষক, তাঁদের সাথে কী নিয়ে কথা বলবো সেটাই বুঝে পাই না। সিম্পোজিয়াম যে হল-রুমে হচ্ছে তার এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি আমি আর নেপালি বন্ধু অনুষ (अनुस श्रेष्ठ)। সে-ও আমার মতো পি এইচ ডি প্রথম বর্ষের ছাত্র। স্থলাবদ্ধ দেশে বেড়ে উঠেছে সে, কখনো সাগর দেখেনি। স্যান ডিয়েগো এসে জীবনে প্রথমবার সাগরের ঢেউ দেখে আনন্দে আত্মহারা — তার উপর সেটা আবার প্রশান্ত মহাসাগর। প্রফেসরদের-দের নারাজ হওয়ার ভয়ে সারাদিন সিম্পোজিয়ামের বিরক্তিকর সব বক্তৃতা শুনলেও, তার মন সারাক্ষণ পড়ে থাকে সৈকতে। ফাঁকফোকর পেলেই দৌড়ে চলে যায় সাগর-পাড়ে, গিয়ে শিশুদের মতো ঝিনুক কুঁড়ায়, বালিতে নাম লিখে সেটার ছবি তুলে। তূর্কি বন্ধু ফারিস অবশ্য লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলার ব্যাপারে বেশ সপ্রতিভ। সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, আমাদের ল্যাবের পুরাতন লোক। গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের কাজে এমনিতেই তার বড় বড় কোম্পানি’র হর্তাকর্তা লোকজনের সাথে কথা বলতে হয় নিয়মিত। তবে একটু ভালোভাবে খেয়াল করে দেখা গেল, সে সেখানকার নারী বক্তাদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে তুলনামূলক কিছুটা বেশি উৎসাহী। সিম্পোজিয়ামের প্রথমদিন ক্রিপ্টোকারেন্সি’র উপর এক জার্মান সুন্দরী’র গবেষণার উপস্থাপনা দেখে, রাতে ক্রিপ্টোকারেন্সি’র উপর বিস্তর পড়ালেখা করা সত্ত্বেও পরের দিন সেই বক্তা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে সে যারপরনাই নাজেহাল হয়েছে এমন খবর আমাদের ল্যাবের নিন্দুকেরা রটাচ্ছে। ঘটনা মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্য ক্ষীণ। নেপালি, তূর্কি আর এই অধম বাঙ্গালী ব্যাতিত বাকি ছাত্রছাত্রী ছিল ইরানি এবং চীনা। চীনা’রা আমাদের যথেষ্ট ‘চিনা’ হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন নিজেদের একটা গ্রুপে একসাথে গল্পগুজবে নিমজ্জিত থাকে সবসময়। এটা শুধু সিম্পোজিয়ামে না, ক্যাম্পাসে- ক্লাসে, ল্যাবে সব জায়গায়। ইরানিরাও এর ব্যাতিক্রম না। আমরা বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী একত্রে থাকলে আমরাও হয়তো নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতাম আমাদের আড্ডডাবাজি। আন্তর্জাতিক আড্ডাবাজি যে একদম হয় নাই তা না। আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পায় ভাষার বৈচিত্র্য। এক ফাঁকে আমি প্রস্তাব দিলাম বিভিন্ন ভাষার কঠিন কঠিন ‘টাং টুইস্টার’ খেলার। খেয়াল করে দেখলাম, এই খেলায় বাংলাভাষী হিসেবে আমার সুবিধা অনেক বেশি। অন্যরা তাদের ভাষার যেসব ‘টাং টুইস্টার’ নিজেরাই বলতে হিমশিম খাচ্ছে, আমি অবলীলায় সেগুলা বলে যাচ্ছি। অবশেষে আমি আমার সাফল্যের গোপন রহস্য উন্মোচন করলাম - বাংলা বর্ণমালায় ৫০ টি বর্ণ। পৃথিবী’র অধিকাংশ ভাষার কঠিন কঠিন ধ্বনি-ই সম্ভবতঃ আমরা অল্পায়াসে রপ্ত করে ফেলতে পারবো। সিম্পোজিয়াম চলাকালে কথা যেটুকু বলেছি সেটা সেখানে দেখা হয়ে যাওয়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত দুইজন বাংলাদেশী তরুণ গবেষক ডঃ এনদাদুল হক ভাই এবং সৈয়দ রাফিউল -এর সাথে। এছাড়া আমার মতোই কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা স্যামুয়েল নামের একটা ছেলের সাথে কয়েকবার কথাবার্তা হয়। কনফারেন্স শেষে award দেয়ার পর দেখা গেল, Distinguished Award পাওয়া প্রথম পেপার-টার লেখক যৌথভাবে সেই স্যামুয়েল এবং এনদাদ ভাই। মন-টা ভালো হয়ে গেল, বেছে বেছে যে দুই একজনের সাথে কথা বলেছি তাঁরাই সেরা এবং এর মধ্যে আমার দেশের লোকও আছে। অবশেষে ঠোঁটকাটা হতে না পারলেও, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, সিম্পোজিয়ামের জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা শুনে কান কিছুটা পেঁকেছে। আমার ল্যাবমেট নেপালি, তূর্কি, চীনা, ইরানি এবং আমেরিকান যেসব ছাত্রছাত্রী ছিল, আমার ‘লেইম-জোক’ শুনে তাদের অবশ্য কান পঁচে যাওয়ার মতো অবস্থা। বাংলা ভাষায় আমার খোঁড়া-কৌতুক ইতিমধ্যেই বাঙ্গালী-সমাজে সর্বজন-নিন্দিত। সেগুলা ইংরেজি-তে অনুবাদের পরেও এতোটা নিন্দা কুড়াবে সেটা আশাতীত ছিল। যাই হোক, শিক্ষা-সফর শেষে লাভ যেটা হলো, আমার মাতৃভাষার শক্তি আরেকটু ভালভাবে অনুধাবন করলাম। তাছাড়া জীবনে প্রথমবার প্রশান্ত-মহাসাগর দেখলাম; আমার ল্যাবমেট-দের অনেকের সাথেই সম্পর্ক বেশ সহজ হয়েছে - যেটা ভবিষ্যতে পি এইচ ডি’র দূর্গম পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে আশা করা যায়।
[এই লেখা Facebook-এ প্রকাশিত আমার এই পোস্ট থেকে কপি পেস্ট করা।]

শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

'আঁসু' ভেজা চোখে দেখা ভেজা ASU

বৃষ্টি-ভেজা ASU -- খুবই বিরল দৃশ্য। 
"arid zone" Arizona-তে বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় কালেভদ্রে।

বৃষ্টি দেখলে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে মন চায়।
"ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাইরে" -- কবিগুরুর সাথে আমার এইখানে কিছুটা মতানৈক্য।
(অবশ্য ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় বৃষ্টি নামলে কবিগুরুর এই বাণী অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতাম ... হাজার হোক কবিগুরু তিনি, মাঝে মাঝে তো অন্তত গুরুর কথার গুরুত্ব দেয়া লাগে।)

গত পরশুদিন ঘুম থেকে উঠে বাইরে বৃষ্টি দেখে দ্রুত ঘর বের হয়ে গেলাম। সেদিন সারাদিনই বৃষ্টি হয়েছে, গুঁড়ি-গুঁড়ি; বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে দেশে যেমন হয়। মেঘলা আকাশ, ভেজা রাস্তা, এইসব দেখে  বাংলাদেশের সমস্ত বাদল দিনের স্মৃতি একসাথে হানা দেয় মনে, চোখের কোনায় দুই এক ফোঁটা পানি জমে -- বৃষ্টির পানিই হবে হয়তো।

মনে পড়ে যায় ১০-১১ বছর আগে এক দিনের কথা। সেদিন SUST ক্যাম্পাসে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ভিজেছিলাম - সাথে ছিল "কবি-রাজ" Farhad। (কবি-রাজ খেতাবটা আমারই দেয়া অবশ্য)। এই ক্যাম্পাসে কবি-রাজ এর মতো সেইরকম ভাবের-ঘোরে আচ্ছন্ন ভবঘুরে সঙ্গী পাওয়া যায় না। এইখানকার মানুষ রোবটের মতো - এরা শখ করে বৃষ্টিতে ভিজে না, 'শর্ট-সার্কিট' হয়ে যাবে এই ভয়েই সম্ভবত। এইখানেও ক্যাম্পাসের আশেপাশে পাহাড়ের অভাব নাই, কিন্তু এই ক্যাম্পাসে কাওসার, Salak, Tareq নাই যাদেরকে নিয়ে ক্যাম্পাসের আশেপাশের সমস্ত পাহাড়ি এলাকা, রাস্তাঘাট যখন-তখন হেঁটে-হেঁটে চষে বেড়ানো যায়...।

'আঁসু' ভেজা চোখে ভেজা ASU দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে। 
দেশের অভ্যাস মতো কিছুক্ষণ পরপর পিছন ফিরে দেখছিলাম প্যান্টের পিছন-টায় কাদা লাগলো কি-না -- দেখা গেল পরিষ্কারই আছে। এখানে বৃষ্টিভেজা রাস্তায় হাঁটা দেশের তুলনায় আরামদায়ক, প্যাঁক-কাদা নাই। রাস্তাঘাট একদম ঝকঝকে।

প্যাঁক-কাদাহীন, এমন মসৃণ রাস্তায় পথচলা এতো কষ্টকর হবে সেটা তো আগে বুঝতে পারি নাই।
[এই লেখা Facebook-এ প্রকাশিত আমার এই পোস্ট থেকে কপি পেস্ট করা।]