মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১

হাতের লেখা

জানি না এখনকার স্কুলে বাচ্চাদের হাতের লেখার সৌন্দর্যের উপর কতোটা গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সুন্দর হাতের লেখা / হাতের সুন্দর লেখা আমাদের সময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল। 

পরীক্ষায় শিক্ষকদের মন ভোলানোর একটা বড় হাতিয়ার ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার হাতের লেখা।

ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত আমার হাতের লেখা ছিল আক্ষরিক অর্থেই "কাউয়ার ঠ্যাঙ, বগার ঠ্যাঙ"। ষষ্ঠ শ্রেণীতে হুমায়রা ম্যাডামের স্কেলের বাড়ি খেয়েছিলাম, খাতায় আমার বিচ্ছিরি লেখা ম্যাডাম পড়তে পারছিলেন না এই কারণে। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম হাতের লেখা ঠিক করতে হবে। ঠিক করলাম ক্লাসে যাদের হাতের লেখা সুন্দর তাদের লেখা নকল করবো। তখন থেকে মেট্রিক পাশ করা পর্যন্ত আমি সম্ভবত ৩০ থেকে ৪০ জনের হাতের লেখা নকল করার চেষ্টা করেছি। প্রথমে শুরু করেছিলাম আমার আব্বার হাতের লেখার মতো লিখতে, সেটা ওই বয়সে বেশ কঠিন মনে হলো, কারণ আব্বার হাতের লেখা ছিল টানা-টানা। এরপর ওবায়দুরের হাতের লেখার মতো লিখতে চেষ্টা করলাম, তারপর কিছুদিন পল্লব এর হাতের লেখা, তারপর ওসমান গণীর "ছাপা অক্ষরের" লেখা। আবদুল্লাহ আল আমিন (মাসুম) এর হাতের লেখাও সুন্দর ছিল, ওইটাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। ক্লাস সেভেন বা এইটে খেয়াল করলাম ফয়সাল বিন হাশেম এর হাতের লেখা অনেক সুন্দর, তৃপ্তি ম্যডাম সার্টিফাই করেছিলেন যে ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দর লেখা ফয়সাল বিন হাশেম এর, তাই ওইটাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। নবম/ দশম শ্রেণীতে জাসেম আল লতিফ আর মইনুদ্দিন চিশতী'র হাতের লেখা নজর কাড়লো, দুইজনের লেখা অনেকটা একই রকম, ছোট ছোট হরফে লিখতো। সেটাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। আব্দুল্লাহ (বাচ্চু)র হাতের লেখা অবিকল ওসমান এর লেখার মতো ছিল। সেটাও আবার কিছুদিন ট্রাই করলাম।

এদের সবার হাতের লেখা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। এতো বেশি চেষ্টা করেছি...।

এতো ঘনঘন হাতের লেখার ফরম্যাট বদলানোর ফলশ্রুতিতে আমার হাতের লেখা দেখতে আগের মতো দূর্বোধ্য আর রইলো না, কিন্তু গতি অনেক কমে গেলো। পরীক্ষায় আর ফুল আনসার করতে পারি না।

এস এস সি'র টেস্ট পরীক্ষার পর মাস দুইয়েক একটা নির্দিষ্ট হাতের লেখা স্থির করেছিলাম, সেই লেখায় উপরোক্ত অনেকের লেখার ছাপ ছিল। সেই ফরম্যাটেই মেট্রিক পরীক্ষা পর্যন্ত প্র‍্যাকটিস করে লেখার গতি কিছুটা বাড়ালাম। কিন্তু তারপরও সমাজে ফুল আনসার করতে পারলাম না। বাংলা দ্বিতীয় পত্রে টেনেটুনে শেষ করেছিলাম।

ইন্টারে উঠে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম, আব্বার হাতের লেখা নকল করার ট্রাই করলাম আবার। এবার কিছুটা সফল হলাম, জেনেটিক্স কিছুটা সাহায্য করেছে সম্ভবত এইক্ষেত্রে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটা ডায়েরিতে লিখতাম অনিয়মিতভাবে। সেটার একেক পাতায় একেক রকম হাতের লেখা ছিল। শুধু তাই না, ওই ডায়েরিতে আমার লেখা ছাড়াও আমার কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধুর লেখাও ছিল, আবুহেনা, আলাল, বাচ্চু, (শানু?), আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার হলের এক রুমমেট।  অনেক ঘটনাবহুল সময়ের স্মৃতিসম্বলিত সেই ডায়েরিটা হারিয়ে গিয়েছে।

শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

"সামাজ"

সামাজিক বিজ্ঞান পড়াইতেন আবু সাইয়্যিদ স্যার, ক্লাসে অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করতেন। মাঝে মধ্যে পড়া ধরতেন, না পারলে স্কেলের বাড়ি দিতেন হাতে।

স্যার গল্প করতে করতে ক্লাসের ৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে ৩৫ মিনিটই পার করে দিতেন। একই গল্প অনেকবার করে শুনেছি আমরা। সম্রাট আকবর এর কাহিনী, তাঁর সভাসদ বীরবল-টোডরমল - এর কাহিনী এইসব দিয়ে শুরু হইতো। আকবর এর বিশেষ একেশ্বরবাদ এর কথা বলতেন স্যার প্রায়ই। আকবর নাকি প্রজাদের পরষ্পর দেখা হলে 'সালাম' দেয়ার বদলে 'আল্লাহু আকবর' বলার প্রথা চালু করতে চেয়েছিলেন (যাতে তার নাম উচ্চারণ হয়)।  বিভিন্ন দেশের মানুষের অভ্যাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসের ধরণ এইরকম অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতেন স্যার। আমাদের খাদ্যাভাসের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা হইতো (আগে মানুষ "কচু"কে অবহেলা করতো, বলতো "কচু খাও", পরবর্তীতে দেখা গেল কচুতে আয়রন-ভিটামিন ... )।

অন্যান্য দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার ব্যাবহার এইসব নিয়েও আলোচনা হইতো। বলতেন আমরা উপমহাদেশের মানুষ ধর্মকর্ম করি শৈশবে, যৌবনে "মৌজ-মাস্তি" করি, আর বৃদ্ধ বয়েসে মরার ভয়ে আবার ধর্ম-কর্ম করি। তুরষ্কের মানুষের স্বভাব নাকি এর ঠিক উলটা। তাঁরা নাকি ধর্ম-কর্ম করে যৌবনে; বৃদ্ধ বয়সে নাকি আবার "ফূর্তি" মোড এ চলে যায় "কয়দিন আর বাঁচবো, একটু আনন্দ ফূর্তি করে নিই" এই চিন্তা করে। (এর প্রমাণ আমি কিছুটা পেয়েছি, এখানে এক তূর্কি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই দুনিয়ায় যত রকমের নেশা-দ্রব্য রয়েছে সব অন্তত একবার ট্রাই করেছে। এখন সে মদ-গাঁজা তো দূরের কথা, বিড়িতেও কখনও একটা টান দেয় না। তবে একজন মানুষের উদাহরণ দিয়ে পুরা জাতি-কে বিচার করাও উচিৎ হবে না।)

আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হতো। আফগানিস্তানকে কেন রাশিয়ার মতো মহাশক্তিও শায়েস্তা করতে পারছে না, ক্লিংটন-মনিকার প্রেমকাহিনী গুজব-নাকি-সত্যি এইজাতীয় অনেক মজার বিষয়।

যেদিন স্যার গল্প শুরু করতেন আমরা মনে মনে খুশি হইতাম, আজকে আর পড়া ধরবেন না স্যার।মাঝে মাঝে স্যারের ক্লাসে পিছনের দিকের বেঞ্চে বসতাম ইচ্ছা করেই। স্যার সামনে থেকে পড়া ধরা শুরু করলে পিছনে আসতে আসতে একবার টপিক-টা দেখে নিতাম। সমাজ মোটামুটি সহজই ছিল, গল্পের মতো। শুধু সন-তারিখ এইরকম কিছু নাম্বার একটু ভালোভাবে দেখে মুখস্থ করে নিতে হইতো, সেসময় তাৎক্ষণিক স্মরণশক্তি ভালো ছিল, কোন কিছু দেখে সাথে সাথে উগরে দিতে পারতাম, পরদিন আর সেটা মনে থাকতো না। এই অভ্যাস সম্ভবত গড়ে উঠেছে বছরের পর বছর শুধুমাত্র পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে পরদিন পরীক্ষার খাতায় "সব-কিছু" লিখে দিয়ে আসার আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে।

ক্লাস সিক্স বা সেভেন এ সম্ভবত তৃপ্তি ম্যাডাম পড়াতেন সামাজিক বিজ্ঞান। আমরা এই বিষয়টাকে 'সমাজ' নামে ডাকলে তিনি রাগ করতেন, বলতে, এটা 'সমাজ' না, 'সামাজ'।  ম্যাডাম পড়ার বাইরে কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করতেন কি-না এখন আর মনে করতে পারছি না। করে থাকলেও হয়তো এতো মজাদার কিছু ছিল না সেগুলা। তবে ম্যাডাম ক্লাসে এসে ফ্যান বন্ধ করে জানালাগুলা সব খুলে দিতে বলতেন এইটা মনে আছে।

আমাদের ব্যাচ থেকে ২০০১ সালে সমাজে এস এস সি-তে এ+ পেয়েছে সম্ভবত মাত্র একজন (রেজাউল হায়াত)। আমাদের লিজেন্ড ছাত্র বেচারা ওসমান গণী-ও পায় নাই, যাকে তৃপ্তি ম্যাডাম একবার ১০০-তে ১০২ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বাংলায় সম্ভবত পুরা স্কুল থেকে কেউ এ+ পায় নাই সেইবার, পাইলেও আমি জানি না, চট্টগ্রাম বোর্ডেই হাতে গোনা কয়েকজন পেয়েছিল।

গ্রেডিং সিস্টেমের প্রথম ব্যাচ, তাই সবাই সব বিষয়ে সমানভাবে গুরুত্বও দেয় নাই। আবার যেসব শিক্ষক খাতা কেটেছেন তাঁরাও সমাজ-বাংলার মতো বর্ণনামূলক বিষয়ে বেশি ছাত্রকে ৮০এর বেশি নাম্বার দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

তৃপ্তি ম্যাডামের ক্লাসে না-বলা কৌতুক

ক্লাস সেভেনের ঘটনা সম্ভবত।

বিকালে খেলার মাঠে এক বড় ভাই একটা দুষ্টু কৌতুক বলেছিলেন। তেমন ভালো মানের কৌতুক না। কিন্তু ওই সময় কেন যেন সেটা আমার বেশ ভালো লাগলো, এবং আমারকচিমনে সেইটা গেঁথে গেলো বেশ ভালোভাবেই। জীবনে এর আগে যত কৌতুক শুনেছি সব কয়েকদিনের জন্য মুছে গেলো মেমোরি থেকে। সারাক্ষণই সেই একই  কৌতুক মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি থেকে থেকে দমকে দমকে হেসে উঠছি একা একাই।

এদিকে সম্প্রতি কিছু কৌতুক বলে ক্লাসেও হালকা জনপ্রিয়তা পেয়েছি আমি। ক্লাসে আনন্দ-ফুর্তি কোনো উপলক্ষ্য এলেই প্রথম দুই-চার জনের মধ্যে আমার কৌতুক বলার প্রস্তাব আসতো (মাঝে মাঝে নিজেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতাম) একদিন কোনো এক স্যার / ম্যাডাম এর অনুপস্থিতিতে রিপ্লেসমেন্ট ক্লাস নিতে এলেন তৃপ্তি ম্যাডাম। ম্যাডামের সেদিন মন বেশ ফুরফুরা। বললেন, আমরা আজকে কোনো পড়াশুনা করবো না। তোমাদের মধ্যে কেউ এসে গান গাও, বা গল্প বলো।

সেদিন আমার পাশে বসা কেউ একজন বলে উঠলো, ম্যাডাম নাসিম খুব ভালো কৌতুক বলে। ম্যাডাম আমাকে বললেন সামনে এসে কিছু একটা বলতে। আমার মাথায় তখনও আগেরদিনের শোনা সেই কৌতুক ঘুরছে, যেটা ক্লাসে বলার মতো না। আমি বললাম ম্যাডাম আজকে কিছু মনে আসছে না। কিন্তু ম্যাডাম জোরাজুরি করতে লাগলেন। ক্লাসে আরও কিছু পোলাপাইনও বলতে শুরু করলো, আরে যা, এতো ভাব নিচ্ছিস ক্যান। 

যাই হোক, অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর সামনে গেলাম। অলরেডি আমি ঘেমে গিয়েছি, পা- হালকা কাঁপছে। ম্যাডাম সাহস দিলেন, “বলো, এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?”

আমি আগেরদিন শোনা সেই কৌতুকটা বলা শুরু করলাম। প্রথম লাইন বলার সাথে সাথেই তৃপ্তি ম্যাডাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা থাকআর বলতে হবে না, গিয়ে বসো

প্রথম লাইন-টা ছিলঃ এক লোক বাজার থেকে একটা আন্ডারওয়্যার কিনে আনলো … “।