১
—
আমাদের উঠতি বয়সের যুবকদের মাদকাসক্ত হওয়া ঠেকাতে না পারা, তাদের সময়মত নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারা, পশুপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার শিক্ষা দিতে না পারা …
এবং ফলশ্রুতিতে
আমাদের মা - বোন - শিশুদেরকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারা, আমাদের পথচারীদের ছিনতাইকারি’র হাতে খুন হওয়া ঠেকাতে না পারা …
এগুলা যেমন আমাদের ব্যার্থতা,
তেমনি,
কোনরকম বিচারের মধ্য দিয়ে না গিয়ে, গুলি করে মেরে ফেলাটাও আমাদের আইন প্রয়োগে বিশাল সাফল্যের কোন সূচক না।
আমার মতো আবেগ-তাড়িত সাধারণ মানুষের মন চায়, “এইসব বিচার ফিচারে মধ্যে যাওয়ার দরকার কী?… চিপায় নিয়া গুলি কইরা মাইরা ফালাইলেই হয়…”। এবং দিনশেষে আমাদের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনই ঘটছে আমাদের প্রশাসনের কর্মকান্ডে। দু-চারটা শিয়াল কুকুর মেরে যদি তড়িৎ গতিতে কোটি কোটি মানুষের মনোরঞ্জন করা যায়, সে সুযোগ কে না লুফে নেয়?
মাঝে মাঝে হয়তো ছোটখাটো কিছু সমস্যা হবে, শিয়াল কুকুরের জায়গায় দুই একটা নিরীহ মানুষের বাচ্চা মারা পড়বে… এবং সেটা কেউ কোনদিন টেরও পাবে না। দু চারটা ছোটখাটো পরিবার তছনছ হয়ে যাবে … বৃহত্তর স্বার্থে হয়তো এক দুইটা নিরীহ পরিবারের ধ্বংস হয়ে যাওয়া খুব ছোট বিষয়।
(এই পর্যায়ে এসে সেই ধর্ষনের শিকার হওয়া পরিবারটার অবর্ণনীয় কষ্টের কথাও আপনার মাথায় আসবে স্বাভাবিকভাবেই। এর মাঝে কোন্ পরিবারের দুঃখ লাঘব করা বেশি জরুরী সেটা নিরূপণ করার উপায় নিয়েও আপনার মাথায় চিন্তা আসতে পারে … সেক্ষেত্রে এই লেখার দ্বিতীয় অংশ পড়ার অনুরোধ করবো।)
ব্যাপারটার ভয়াবহতা আমি এখন টের পাচ্ছি না, হয়ত “মাইরা ফালাইছে ভালো করছে, এইগুলারে এমনেই মারা উচিত” বলে হাততালি দিচ্ছি। কিন্তু ভয়াবহতা টের পাবো, যখন “উপরমহলের” চাপে পড়ে, ন্যায়বিচারের কৃত্রিম আবহ সৃষ্টির প্রয়াসে, জনগণমনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে প্রশাসন আমার আপনার ঘর থেকেই কাউকে (হয়তো আমাদের কোন এক ছোট ভাই/ নিকটাত্মীয়কে) অস্ত্রোদ্ধারের উদ্দেশ্যে জীবন্ত নিয়ে যাবে এবং লাশ ফেরত দিবে। পরদিন আপনার পরিবারে যখন আপনার নিরপরাধ আত্মীয় হারানোর শোকের মাতন, তখন পুরা দেশ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলবে, “যাক পুলিশ/র্যাব অনেক তৎপর, হারামীডারে সাথে সাথে ধইরা মাইরা ফালাইছে”।
ফুলের মতো শিশুদেরকে যেসব শিয়াল কুকুর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করছে, তাদের বিচার যেমন জরুরী, ঠিক তেমনভাবে এটা নিশ্চিত করাও জরুরী যে কোন নিরপরাধ ব্যাক্তিকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হচ্ছে না।
বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে আমি বিশ্বাস করতে চাই - আমাদের র্যাব - পুলিশ - প্রশাসনে সৎ, চৌকশ এবং দক্ষ লোকজনের অভাব নাই, এবং তারা অন্তত এটুকু নিশ্চিত করছে যে নির্দিষ্ট অপরাধে দোষী ব্যাক্তিই এইসব “অনিচ্ছাকৃত ক্রসফায়ারজনিত দুর্ঘটনায়” মারা পড়ছে।
২
—
রেললাইনের উপর আপনি একটা ‘ট্ট্রলি কার’ চালাচ্ছেন, হঠাৎ খেয়াল করলেন যে ট্রেনের ব্রেক কাজ করছে না। সামনে পাঁচজন শ্রমিক লাইনের উপর কাজ করছে। আপনি জানেন, যদি এই গতিতে ওদের উপর দিয়ে ট্রেন চালিয়ে দেন, তাহলে সবাই মারা পড়বে। অন্যদিকে, সামনে লাইনটা বিভাজিত হয়ে আরেকটা পথে গিয়েছে; ধরুন, আপনি চাইলে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে সে পথেও যেতে পারেন। এবং সে লাইনের উপর মাত্র একজন লোক কাজ করছে। এক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে ভিন্ন পথে গিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একজন মানুষকে মারবেন? নাকি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থেকে সোজা যেমন চলছিলেন চলতে থাকবেন?
আপনি হয়তো বলবেন, “পাঁচজনকে মারার চেয়ে বরং একজনকে মারবো।”
আপনার কোন এক বন্ধু হয়তো বলবে, “আমি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গতিপথ পরিবর্তন করে সেই একজন লোকের উপর দিয়ে ট্রলি চালিয়ে দিই, সেটা হবে পরিকল্পিত হত্যা …”।
কিছুদিন আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের একটা লেকচারের ভিডিও দেখছিলাম [লিঙ্ক নিচে দেয়া আছে]
লেকচার-টা বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের সাথে খুব বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ না। তবে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের নৈতিক বিচারের মাপকাঠি’র সাপেক্ষে সঠিক আইন প্রণয়ন যে কতো জটিল একটা বিষয় সেটা এই লেকচার-টা দেখলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
সেখানে এই জাতীয় বেশ কিছু বিষয়ে অভিমত চাওয়া হয় ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। উপরে উল্লেখিত বিষয়টি খুবই সহজ একটা উদাহরণ, এরকম আরও অনেক বিষয় আছে, নৈতিকতার বিচারে যেগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা কষ্টকর। ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত এবং সেগুলার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তি-তর্ক শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম- নৈতিক বিচারের ভিত্তিতে সর্বজনগৃহীত মানদণ্ড প্রণয়ন করা বেশ কঠিন একটা কাজ।
এবং এটা খুব স্বাভাবিক যে এ সমস্ত আইনের প্রয়োগ চালু রাখতে গেলে আমার মতো অনেক আবেগি মানুষ কিছু কিছু বিতর্কিত পরিস্থিতিতে ভেটো দিয়ে বসবো।
এজন্য মানুষ সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই আইন নিয়ে গবেষণা করে আসছে, এবং এই গবেষণার বিষয়বস্তুর কখনো অভাব হবে না।
আমার মতো মূর্খের আইন নিয়ে আর বেশি কথা বলা মনে হয় আইনত ঠিক হবে না।
ভিডিওটা দেখবেন। বিনোদনমূলক এবং চিন্তাউদ্রেককারী।
---
"Justice: What's The Right Thing To Do?
Episode 01: THE MORAL SIDE OF MURDER"
https://www.youtube.com/watch?v=kBdfcR-8hEY
—
আমাদের উঠতি বয়সের যুবকদের মাদকাসক্ত হওয়া ঠেকাতে না পারা, তাদের সময়মত নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারা, পশুপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার শিক্ষা দিতে না পারা …
এবং ফলশ্রুতিতে
আমাদের মা - বোন - শিশুদেরকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারা, আমাদের পথচারীদের ছিনতাইকারি’র হাতে খুন হওয়া ঠেকাতে না পারা …
এগুলা যেমন আমাদের ব্যার্থতা,
তেমনি,
কোনরকম বিচারের মধ্য দিয়ে না গিয়ে, গুলি করে মেরে ফেলাটাও আমাদের আইন প্রয়োগে বিশাল সাফল্যের কোন সূচক না।
আমার মতো আবেগ-তাড়িত সাধারণ মানুষের মন চায়, “এইসব বিচার ফিচারে মধ্যে যাওয়ার দরকার কী?… চিপায় নিয়া গুলি কইরা মাইরা ফালাইলেই হয়…”। এবং দিনশেষে আমাদের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনই ঘটছে আমাদের প্রশাসনের কর্মকান্ডে। দু-চারটা শিয়াল কুকুর মেরে যদি তড়িৎ গতিতে কোটি কোটি মানুষের মনোরঞ্জন করা যায়, সে সুযোগ কে না লুফে নেয়?
মাঝে মাঝে হয়তো ছোটখাটো কিছু সমস্যা হবে, শিয়াল কুকুরের জায়গায় দুই একটা নিরীহ মানুষের বাচ্চা মারা পড়বে… এবং সেটা কেউ কোনদিন টেরও পাবে না। দু চারটা ছোটখাটো পরিবার তছনছ হয়ে যাবে … বৃহত্তর স্বার্থে হয়তো এক দুইটা নিরীহ পরিবারের ধ্বংস হয়ে যাওয়া খুব ছোট বিষয়।
(এই পর্যায়ে এসে সেই ধর্ষনের শিকার হওয়া পরিবারটার অবর্ণনীয় কষ্টের কথাও আপনার মাথায় আসবে স্বাভাবিকভাবেই। এর মাঝে কোন্ পরিবারের দুঃখ লাঘব করা বেশি জরুরী সেটা নিরূপণ করার উপায় নিয়েও আপনার মাথায় চিন্তা আসতে পারে … সেক্ষেত্রে এই লেখার দ্বিতীয় অংশ পড়ার অনুরোধ করবো।)
ব্যাপারটার ভয়াবহতা আমি এখন টের পাচ্ছি না, হয়ত “মাইরা ফালাইছে ভালো করছে, এইগুলারে এমনেই মারা উচিত” বলে হাততালি দিচ্ছি। কিন্তু ভয়াবহতা টের পাবো, যখন “উপরমহলের” চাপে পড়ে, ন্যায়বিচারের কৃত্রিম আবহ সৃষ্টির প্রয়াসে, জনগণমনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে প্রশাসন আমার আপনার ঘর থেকেই কাউকে (হয়তো আমাদের কোন এক ছোট ভাই/ নিকটাত্মীয়কে) অস্ত্রোদ্ধারের উদ্দেশ্যে জীবন্ত নিয়ে যাবে এবং লাশ ফেরত দিবে। পরদিন আপনার পরিবারে যখন আপনার নিরপরাধ আত্মীয় হারানোর শোকের মাতন, তখন পুরা দেশ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলবে, “যাক পুলিশ/র্যাব অনেক তৎপর, হারামীডারে সাথে সাথে ধইরা মাইরা ফালাইছে”।
ফুলের মতো শিশুদেরকে যেসব শিয়াল কুকুর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করছে, তাদের বিচার যেমন জরুরী, ঠিক তেমনভাবে এটা নিশ্চিত করাও জরুরী যে কোন নিরপরাধ ব্যাক্তিকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হচ্ছে না।
বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে আমি বিশ্বাস করতে চাই - আমাদের র্যাব - পুলিশ - প্রশাসনে সৎ, চৌকশ এবং দক্ষ লোকজনের অভাব নাই, এবং তারা অন্তত এটুকু নিশ্চিত করছে যে নির্দিষ্ট অপরাধে দোষী ব্যাক্তিই এইসব “অনিচ্ছাকৃত ক্রসফায়ারজনিত দুর্ঘটনায়” মারা পড়ছে।
২
—
রেললাইনের উপর আপনি একটা ‘ট্ট্রলি কার’ চালাচ্ছেন, হঠাৎ খেয়াল করলেন যে ট্রেনের ব্রেক কাজ করছে না। সামনে পাঁচজন শ্রমিক লাইনের উপর কাজ করছে। আপনি জানেন, যদি এই গতিতে ওদের উপর দিয়ে ট্রেন চালিয়ে দেন, তাহলে সবাই মারা পড়বে। অন্যদিকে, সামনে লাইনটা বিভাজিত হয়ে আরেকটা পথে গিয়েছে; ধরুন, আপনি চাইলে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে সে পথেও যেতে পারেন। এবং সে লাইনের উপর মাত্র একজন লোক কাজ করছে। এক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে ভিন্ন পথে গিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একজন মানুষকে মারবেন? নাকি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থেকে সোজা যেমন চলছিলেন চলতে থাকবেন?
আপনি হয়তো বলবেন, “পাঁচজনকে মারার চেয়ে বরং একজনকে মারবো।”
আপনার কোন এক বন্ধু হয়তো বলবে, “আমি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গতিপথ পরিবর্তন করে সেই একজন লোকের উপর দিয়ে ট্রলি চালিয়ে দিই, সেটা হবে পরিকল্পিত হত্যা …”।
কিছুদিন আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের একটা লেকচারের ভিডিও দেখছিলাম [লিঙ্ক নিচে দেয়া আছে]
লেকচার-টা বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের সাথে খুব বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ না। তবে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের নৈতিক বিচারের মাপকাঠি’র সাপেক্ষে সঠিক আইন প্রণয়ন যে কতো জটিল একটা বিষয় সেটা এই লেকচার-টা দেখলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
সেখানে এই জাতীয় বেশ কিছু বিষয়ে অভিমত চাওয়া হয় ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। উপরে উল্লেখিত বিষয়টি খুবই সহজ একটা উদাহরণ, এরকম আরও অনেক বিষয় আছে, নৈতিকতার বিচারে যেগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা কষ্টকর। ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত এবং সেগুলার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তি-তর্ক শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম- নৈতিক বিচারের ভিত্তিতে সর্বজনগৃহীত মানদণ্ড প্রণয়ন করা বেশ কঠিন একটা কাজ।
এবং এটা খুব স্বাভাবিক যে এ সমস্ত আইনের প্রয়োগ চালু রাখতে গেলে আমার মতো অনেক আবেগি মানুষ কিছু কিছু বিতর্কিত পরিস্থিতিতে ভেটো দিয়ে বসবো।
এজন্য মানুষ সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই আইন নিয়ে গবেষণা করে আসছে, এবং এই গবেষণার বিষয়বস্তুর কখনো অভাব হবে না।
আমার মতো মূর্খের আইন নিয়ে আর বেশি কথা বলা মনে হয় আইনত ঠিক হবে না।
ভিডিওটা দেখবেন। বিনোদনমূলক এবং চিন্তাউদ্রেককারী।
---
"Justice: What's The Right Thing To Do?
Episode 01: THE MORAL SIDE OF MURDER"
https://www.youtube.com/watch?v=kBdfcR-8hEY
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন