শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

"সামাজ"

সামাজিক বিজ্ঞান পড়াইতেন আবু সাইয়্যিদ স্যার, ক্লাসে অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করতেন। মাঝে মধ্যে পড়া ধরতেন, না পারলে স্কেলের বাড়ি দিতেন হাতে।

স্যার গল্প করতে করতে ক্লাসের ৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে ৩৫ মিনিটই পার করে দিতেন। একই গল্প অনেকবার করে শুনেছি আমরা। সম্রাট আকবর এর কাহিনী, তাঁর সভাসদ বীরবল-টোডরমল - এর কাহিনী এইসব দিয়ে শুরু হইতো। আকবর এর বিশেষ একেশ্বরবাদ এর কথা বলতেন স্যার প্রায়ই। আকবর নাকি প্রজাদের পরষ্পর দেখা হলে 'সালাম' দেয়ার বদলে 'আল্লাহু আকবর' বলার প্রথা চালু করতে চেয়েছিলেন (যাতে তার নাম উচ্চারণ হয়)।  বিভিন্ন দেশের মানুষের অভ্যাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসের ধরণ এইরকম অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতেন স্যার। আমাদের খাদ্যাভাসের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা হইতো (আগে মানুষ "কচু"কে অবহেলা করতো, বলতো "কচু খাও", পরবর্তীতে দেখা গেল কচুতে আয়রন-ভিটামিন ... )।

অন্যান্য দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার ব্যাবহার এইসব নিয়েও আলোচনা হইতো। বলতেন আমরা উপমহাদেশের মানুষ ধর্মকর্ম করি শৈশবে, যৌবনে "মৌজ-মাস্তি" করি, আর বৃদ্ধ বয়েসে মরার ভয়ে আবার ধর্ম-কর্ম করি। তুরষ্কের মানুষের স্বভাব নাকি এর ঠিক উলটা। তাঁরা নাকি ধর্ম-কর্ম করে যৌবনে; বৃদ্ধ বয়সে নাকি আবার "ফূর্তি" মোড এ চলে যায় "কয়দিন আর বাঁচবো, একটু আনন্দ ফূর্তি করে নিই" এই চিন্তা করে। (এর প্রমাণ আমি কিছুটা পেয়েছি, এখানে এক তূর্কি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই দুনিয়ায় যত রকমের নেশা-দ্রব্য রয়েছে সব অন্তত একবার ট্রাই করেছে। এখন সে মদ-গাঁজা তো দূরের কথা, বিড়িতেও কখনও একটা টান দেয় না। তবে একজন মানুষের উদাহরণ দিয়ে পুরা জাতি-কে বিচার করাও উচিৎ হবে না।)

আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হতো। আফগানিস্তানকে কেন রাশিয়ার মতো মহাশক্তিও শায়েস্তা করতে পারছে না, ক্লিংটন-মনিকার প্রেমকাহিনী গুজব-নাকি-সত্যি এইজাতীয় অনেক মজার বিষয়।

যেদিন স্যার গল্প শুরু করতেন আমরা মনে মনে খুশি হইতাম, আজকে আর পড়া ধরবেন না স্যার।মাঝে মাঝে স্যারের ক্লাসে পিছনের দিকের বেঞ্চে বসতাম ইচ্ছা করেই। স্যার সামনে থেকে পড়া ধরা শুরু করলে পিছনে আসতে আসতে একবার টপিক-টা দেখে নিতাম। সমাজ মোটামুটি সহজই ছিল, গল্পের মতো। শুধু সন-তারিখ এইরকম কিছু নাম্বার একটু ভালোভাবে দেখে মুখস্থ করে নিতে হইতো, সেসময় তাৎক্ষণিক স্মরণশক্তি ভালো ছিল, কোন কিছু দেখে সাথে সাথে উগরে দিতে পারতাম, পরদিন আর সেটা মনে থাকতো না। এই অভ্যাস সম্ভবত গড়ে উঠেছে বছরের পর বছর শুধুমাত্র পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে পরদিন পরীক্ষার খাতায় "সব-কিছু" লিখে দিয়ে আসার আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে।

ক্লাস সিক্স বা সেভেন এ সম্ভবত তৃপ্তি ম্যাডাম পড়াতেন সামাজিক বিজ্ঞান। আমরা এই বিষয়টাকে 'সমাজ' নামে ডাকলে তিনি রাগ করতেন, বলতে, এটা 'সমাজ' না, 'সামাজ'।  ম্যাডাম পড়ার বাইরে কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করতেন কি-না এখন আর মনে করতে পারছি না। করে থাকলেও হয়তো এতো মজাদার কিছু ছিল না সেগুলা। তবে ম্যাডাম ক্লাসে এসে ফ্যান বন্ধ করে জানালাগুলা সব খুলে দিতে বলতেন এইটা মনে আছে।

আমাদের ব্যাচ থেকে ২০০১ সালে সমাজে এস এস সি-তে এ+ পেয়েছে সম্ভবত মাত্র একজন (রেজাউল হায়াত)। আমাদের লিজেন্ড ছাত্র বেচারা ওসমান গণী-ও পায় নাই, যাকে তৃপ্তি ম্যাডাম একবার ১০০-তে ১০২ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বাংলায় সম্ভবত পুরা স্কুল থেকে কেউ এ+ পায় নাই সেইবার, পাইলেও আমি জানি না, চট্টগ্রাম বোর্ডেই হাতে গোনা কয়েকজন পেয়েছিল।

গ্রেডিং সিস্টেমের প্রথম ব্যাচ, তাই সবাই সব বিষয়ে সমানভাবে গুরুত্বও দেয় নাই। আবার যেসব শিক্ষক খাতা কেটেছেন তাঁরাও সমাজ-বাংলার মতো বর্ণনামূলক বিষয়ে বেশি ছাত্রকে ৮০এর বেশি নাম্বার দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন